হ্যাপি টিচার্স ডে
#হ্যাপি_টিচার্স_ডে
কলমেঃ #স্বাতী_বোল
"কি রে এত মন খারাপ কেন? বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া নাকি?" একটু মজার ছলে জিজ্ঞেস করল অয়ন্তিকা।
কলেজে আসার পর থেকেই মন খারাপ পৌলমীর৷ মুখ ভার করে বসে আছে কলেজে আসার পর থেকেই। আজ টিচার্স ডে বলে অনেক ক্লাস অফ ওদের কলেজে। সুতরাং মন খারাপ না করে বরং আনন্দ করার দিন আজকে। পড়াশুনো করতে আর কারই বা ভালো লাগে। কিন্তু পৌলমীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না একেবারে যে এই ক্লাস অফ গুলো সে এঞ্জয় করছে। বরং তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে অন্যমনস্ক হয়ে কি জানি ভাবছে। অন্যমনস্ক থাকার কারণেই হয়ত অয়ন্তিকার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না পৌলমী। অয়ন্তিকা একটু বিরক্তই হল তাতে। এত অদ্ভূত ব্যবহার কেন করছে পৌলমী সে বুঝতে পারল না। পৌলমীও নিজের খেয়ালে ডাইরি বের করে ক্লাসের লেকচারে মন দিল। পৌলমীর যে আজকে ক্লাস করতেও ভালো লাগছে। বড্ড বিরক্ত লাগছে সব কিছু। সদাহাস্য প্রাণবন্ত মেয়েটি যেন হঠাৎ আজকে নিস্তব্ধ। ক্লাস শেষ হওয়ার পর যখন তার সব বন্ধু বান্ধবীরা ক্যান্টিনে গিয়ে বসে গল্প করছিল, পৌলমী তখন একা ক্লাসে বসে তার ব্যাগে রাখা চকোলেট আর পেনটার দিকে তাকাচ্ছিল। তার আজ সুজয়ের ওপর বড্ড বেশি রাগ হচ্ছে। প্রতি বছর কলেজে আসার সময় সুজয়কে চকোলেট আর পেন দিয়েই কলেজে ঢোকে সে৷ কিন্তু এবার তা আর হয় নি। সুজয়কে কাল রাতে তিন চারবার ফোনও করেছিল সে কিন্তু সুজয় ফোনও ধরে নি। ফলে আজ তাই মন একদম ভালো নেই তার৷ সুজয়দের বাড়িতে গেলেই হয়ত সুজয়ের খোজ নিতে পারত সে। কিন্তু সুজয়ের বাড়ির লোক তাকে একদম পছন্দ করে না ফলে সেখানে গিয়ে খোজ নিতে পারে নি মেয়েটি৷ সুজয় আজ কেন এল না জানা হয় নি তার৷ ক্যান্টিন থেকে দুবার অয়ন্তিকা এসে ডেকে গেল তাকে। পৌলমী উঠছে না দেখে রেগে বলল,
"কি হয়েছে রে তোর? সুজয় দা কিছু বলেছে?"
পৌলমী একটু রাগ দেখিয়ে বলল,
"না কিছু বলবে কেন? আমার গিফট না নিলেই বা কি হয় তার কি ছাত্র ছাত্রী কম আছে নাকি। "
অয়ন্তিকা হেসে বলল,
" যাহ বাবা। তা এত রাগ করার কি আছে। দাদা পরে গিফট নিয়ে নেবে। ব্যস্ত আছে হয়ত। এত রাগের কি আছে। চল রে সবাই গল্প করছি তুইও চল। "
পৌলমী গেল না তার সাথে। অয়ন্তিকা তার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে তার কথা বুঝল না বলে পৌলমীর কষ্ট যেন আরো দ্বিগুন হয়ে গেল। অয়ন্তিকা চলে যাওয়ার পর ব্যাগে রাখা চকোলেট এবং পেনের দিকে তাকিয়ে রাগে অভিমানে দুচোখ জলে ভরে এল তার। বেঞ্চের ওপর মাথা নামিয়ে বক্সে কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পরল সে। ঘুমের মধ্যেই সে পৌছে গেল তার অতীতের প্রেক্ষাপটে।
আজ থেকে প্রায় পাচ বছর আগে সুজয়ের সাথে নাটকীয়ভাবে দেখা হয়েছিল পৌলমীর৷ প্রায় বছর দশেক আগে সুজয় সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরী খুজছে হন্যে হয়ে৷ বাড়িতে বেশ কয়েকটা টিউশনও পড়াত সে। টিউশন পড়াতে পড়াতেই তার সাথে আলাপ হয়েছিল স্মৃতিলেখার, সুজয়ের বাবার এক বন্ধুর মেয়ে৷ একই বয়সী ছিল তারা। সুজয় স্মৃতির ভাইকে পড়াতে যেত তার বাড়িতে৷ ধীরে ধীরে জমে উঠেছিল তার এবং স্মৃতির আলাপ চারিতা। আলাপচারিতা ধীরে ধীরে পরিণতি পেয়েছিল বন্ধুত্বে। স্মৃতিও আকর্ষিত হয়েছিল সুজয়ের ব্যক্তিত্বে। বন্ধুত্ব তাই প্রেমে পরিণত হতে খুব বেশি সময় নেয় নি। তাদের মধ্যে আর্থসামাজিক ব্যবধান ছিল অনেক খানি। কিন্তু ভালোবাসা এত কিছু দেখে কখনো হয় কি? তাদেরও হয় নি৷ স্মৃতিদের পরিবারের আর্থসামাজিক উচ্চতার কাছে সুজয়ের পরিবার নেহাতই নগন্য৷ কিন্তু তাও স্মৃতি এবং সুজয় স্বপ্ন দেখত একসাথে ঘর বাধার৷ ভিক্টোরিয়ার সবুজ ঘাসের ওপর বসে সুজয়ের কাধে মাথা রেখে স্মৃতি তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলোকে রঙীন করা চেষ্টা করত। সুজয় যখন চাকরীর ইন্টারভিউতে ব্যর্থ হয়ে বিমর্ষ হয়ে পরত, স্মৃতি তার হাত ধরে তাকে সাহস জুগিয়ে বলত,
"আমি জানি সুজয় তুমি পারবে৷ তোমার ওপর আমার সে আস্থা আছে। "
স্মৃতির কথা শুনে মনে জোর পেত সুজয়৷ আবার সে প্রস্তুতি নিত লড়াই করার। স্মৃতি প্রায়শই তার বেতন থেকে সুজয়ের জন্যে পড়ার বই কিনে আনত, সে সুজয়কে একটি সরকারী চকরীর প্রস্তুতি নেওয়ার কোচিং এও ভর্তি করে দিয়েছিল। অনেকে অনেক ভাবেই কটাক্ষ করত তাই সুজয়কে৷ মাঝে মাঝে সুজয়ের মনোবল ভেঙ্গে যেত তাদের কথা শুনে। কিন্তু তার পরক্ষণেই মানসিক জোরের জোগান দিত স্মৃতি। সুজয়কে বোঝাত লোকের কথায় কান না দিয়ে নিজের কাজ করে যেতে। সুজয়ও শুনত সে কথা। স্মৃতির হাত ধরে কবে যে সুজয় এবং স্মৃতির সম্পর্ক পাচবছর অতিক্রম করেছিল বুঝতেও পারে নি তারা৷ সম্পর্ক গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয়েছিল তাদের। তারা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারত না। কিন্তু নিয়তি যে বড় নিষ্ঠুর, সে তাদের গল্প লিখছিল অন্যভাবে। প্রতিদিনের মত আজ স্মৃতির অফিসে না গিয়ে সেদিন সন্ধ্যেতে কোচিং থেকে বেরিয়ে সুজয় অপেক্ষা করছিল স্মৃতির৷ আজ কোচিং থেকে বেরিয়ে একটু ক্লান্তি অনুভব হওয়ায় কোচিং এর বাইরেই অপেক্ষা করছিল সুজয়৷ সেদিন দুঘন্টা অপেক্ষা করার পরেও ফোনে কিছুতেই পাচ্ছিল না স্মৃতিকে। নট রিচেবল বলছিল বারবার। প্রায় তিনঘন্টা অপেক্ষা করার পর সুজয়ের নাম্বারে ফোন এসেছিল স্মৃতির নাম্বার থেকে৷ পুলিশ জানিয়েছিল এক বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছে স্মৃতি। সুজয় সেদিন পাগলের মত ছুটে গিয়েছিল স্মৃতির কাছে, স্মৃতির থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত শরীরটাকে একবার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার জন্যে। স্মৃতিকে যে সে আর কোনোদিন দেখতে পাবে না সেটা যেন মেনেই নিতে পারছিল না সুজয়৷ স্মৃতির মিষ্টি হাসি, ছোট ছোট অভিমান, তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়া কথাগুলো যে আর কখনো দেখতে এবং শুনতে পাবে না সে, তা যেন কিছুতেই মানতে পারছিল সুজয়৷ নিজেকে বারবার দোষারোপ করছিল সুজয়। কেন সে অন্যদিনের মত স্মৃতির অফিসে যায় নি, তাহলে হয়ত এমনটা হত না স্মৃতির সাথে। নিজের ওপর এক অদ্ভূত ঘৃণা রাগ হচ্ছিল সুজয়ের। স্মৃতির রক্তাক্ত শরীরটাকে দেখে তার মনে হচ্ছিল সে ই দায়ী এসবের জন্যে৷
স্মৃতি জীবিত থাকাকালীন মাঝে মাঝে মজার ছলে সুজয়কে বলত,
"শোনো না আমি যদি আমাদের বিয়ের আগে মারা যাই, তবুও তুমি কিন্তু এয়োস্ত্রীর মতই আমার মুখাগ্নি করবে।"
স্মৃতির মুখে এই কথাটি শুনলেই ক্ষেপে যেত সুজয়। স্মৃতিকে ছাড়া যে এক পাও চলা সম্ভব নয় তার। কিন্তু সেই কথাটিই যে এভাবে সত্যি হবে ভাবে নি সুজয়। স্মৃতিকে দাহ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার মনে হচ্ছিল সে দাহ করছে নিজের স্বপ্নগুলোকে৷ তার মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার সব জীবনীশক্তি হরণ করে নিচ্ছে৷ স্মৃতি চলে যাওয়ার পর তাই সুজয় নিজের কষ্টগুলোকে ভুলে থাকতে সারাদিন নেশায় ডুবে থাকতে শুরু করে। স্মৃতির সেই থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত শরীরটা যে বারবার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বারবার তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তার অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি কুড়ে কুড়ে রোজ খাচ্ছিল তাকে। সে ক্রমশ কুসঙ্গে আসক্ত হচ্ছিল। মদ, ড্রাগ কিছুই যে নেওয়া বাকি ছিল না তার। এরকমই একদিন নেশায় বিভোর সুজয় তার সদ্য পরিচিত কিছু কুসঙ্গীদের সাথে মিলে পৌছে গিয়েছিল রেড লাইট এড়িয়ায়। হয়ত শান্তির খোজে, কিংবা নিজেকে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়ার জন্যে৷ সেখানেই তার পরিচয় হয় ছোট্ট পৌলমীর সাথে। বয়স তখন মাত্র চোদ্দ বছর। সুজয়ের ঘরে সেদিন পাঠানো হয়েছিল তাকে। ছোট পৌলমী খুব কাদছিল সেদিন৷ কদিন আগেই যে সে শিকার হয়েছিল ধর্ষণের। ভীষণ ভয় ও ঘেন্না তার বাবুদের প্রতি। সুজয়কেও তাই সেরকমই ভেবেছিল সে। কিন্তু নেশাগ্রস্ত থাকা সত্ত্বেও সুজয় পশু হয়ে উঠতে পারে নি সেদিন। পৌলমীকে দেখে এক অদ্ভূত মায়া জন্মেছিল তার। পৌলমীর মধ্যে সে নিজের বোনের মুখটা দেখতে পেয়েছিল, তারও বাড়িতে বোন আছে পৌলমীর বয়সীই৷ আর তাই হয়ত পৌলমীকে স্নেহ মাখা হাতে খাটের ওপর বসিয়ে তার সাথে সারারাত গল্প করেছিল সে। কথা বলতে বলতে ছোট্ট পৌলমীরও বিশ্বাস জন্মেছিল তার ওপর। পৌলমীর মাথায় স্নেহমাখা হাত রেখে বলেছিল,
"তুই পড়াশুনো করবি বোন?"
পৌলমী ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিল সেদিন। পৌলমীকে দেখে পৌলমীকে একটি ভালো জীবন দেওয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছিল সুজয়। অনেক কষ্ট কর এক ভাইফোটায় পৌলমীকে সেই নরক থেকে বের করে এনেছিল সে। ভাইফোটায় সেটাই হয়ত নেস্ট গিফট দেওয়া হয়েছিল তাকে। সুজয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসার পরেও যেন নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়ের তকমা মোছে নি পৌলমীর জীবন থেকে। আর তাই হয়ত সুজয়ের বাড়িতে ঠাই হয় নি তার৷ কিন্তু স্মৃতির মা বাবা পৌলমীকে মেনে নিতে দ্বিধা করে নি একেবারেই। ফলে তার ঠাই হয় স্মৃতির বাড়িতেই। স্মৃতির মা বাবাই তাই নিয়ম মেনে দত্তক নেয় পৌলমীকে। পৌলমীকে উন্নত জীবন দেওয়ার মাধ্যমে সুজয় যেন আবার বেচে থাকার রসদ খুজে পায়। পৌলমীকে আকড়েই বাচতে শেখে আবার নতুন করে।
সুজয়ের এই দুঃসাহসিক কর্মকান্ডের কথা জানতে পারে মিডিয়া। খুব অল্প সময়ে পপুলারিটিও পেয়ে যায় সে। তার ভাগ্যের উত্থান শুরু হয়। কোচিং বাড়িতে থাকে তার। ধীরে ধীরে সে টাকা জমিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে একটি নিজস্ব স্কুলও শুরু করে। পৌলমী এবং সুজয় যেন হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। তারা যেন নিজেদের অজান্তেই হয়ে ওঠে একে অপরের শিক্ষক। তারা যে পরস্পর পরস্পরকে বাচতে শিখিয়েছে।
হঠাৎ ব্যাগে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠে পৌলমীর। মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। ব্যাগ থেকে ফোন বের করেই দেখতে পায় সুজয় ফোন করছে তাকে। একটু অভিমান নিয়েই ফোনটা রিসিভ করে সে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সুজয় নরম সুরে বলে,
"হ্যাপি টিচার্স ডে মাই ফেভারিট টিচার। চল তোকে আজকে মোমো খাইয়ে নিয়ে আসি। রাগ করিস না মনা, আজকে একটু সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে কাল রাতে ট্রাস্টিদের সাথে মিটিং করে দেরী হয়ে গেছে ফিরতে, মোবাইল দেখার সময়ই পাই নি। "
সুজয়ের কথা শুনে অভিমান একটু হলেও কমল পৌলমীর৷ কারণ মোমো খেতে পৌলমী ভীষণ ভালোবাসে। তাই পৌলমী যখনই রেগে যায়, সুজয় তার বোনের মানভঞ্জন করতে ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। পৌলমী কলেজের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সুজয়ের হাতে চকোলেট এবং পেনটা দিয়ে তার পায়ে নমস্কার করে বলল,
"হ্যাপি টিচার্স ডে দাদা। "
অতঃপর তারা দুই ভাইবোন কলেজ থেকে অদূরে এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে মোমো খেয়ে সেলিব্রেট করল তাদের টিচার্স ডে।