শেষ_কথোপকথন

# *শেষ_কথোপকথন*
              *~প্রসেনজিৎ পাল।*
           অনেকদিন হলো গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না। কলেজ জীবন শেষে চাকরীর কারনেই বেঙ্গালুরুতে আছি পাঁচ বছর। পুজোর ছুটির জন্যই বাড়ি ফেরা। মা ফোন করে বললো-  *কিরে! এবারে পুজোতে বাড়ি আসছিস তো?* মায়ের কথায় কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও দশ দিনের ছুটি নিয়ে সমস্ত কাজ আমার সহকর্মী অর্পনের উপর ছেড়ে দিয়ে আসতে হলো। আসলে অর্পন কলকাতার ছেলে এবং যথেষ্ট সৎ আর সেই কারনেই চোখ বুঝে ওর উপর ভরসা করা চলে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। সহযাত্রী বলতে আমার ল্যাপটপ, আর একটা হেডফোন সাথে একটা বিরাট বড়ো ট্রলি ব্যাগ। ১০ দিনের মতো জামাকাপড় সব অভদ্রভাবে ঠেসে ঠেসে ট্রলি ব্যাগটা ভর্তি করেছি, মা দেখলে নির্ঘাত কান টেনে ধরবে জানতাম। গ্রামের বাড়ি পৌছালাম চতুর্থীর দিন। ঠিক তাই, বাড়ি পৌছে যখন ট্রলি ব্যাগটা আমার পুরানো ঘরটাতে রাখলাম, কিছুক্ষন পরেই মা সেটাকে নিয়ে গবেষনা করতে করতে বললো-" যাচ্ছে তাই! কিরে কি হয়েছিস বলতো তুই! নিজের জামাকাপড়গুলো সব দলা পাকিয়ে একসাথে করে দিয়েছিস সয়তান! " আর তার পরেই ঠিক কানমোলা। আমি ডাল ভালো খাই, আর তাই মা ডাল, আলুভাজা আর মাংস নিয়ে হাজির দুপুর হতে না হতেই। দুপুরে ভাত খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম, তারপর সেই পুরানো খেলার মাঠ, আড্ডা দেওয়ার জায়গাগুলো আর গ্রামের বন্ধুগুলোর সাথে ম্যারাথন আড্ডা, গল্প। সত্যি বলতে বেঙ্গালুরুতে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থাপনা থাকলেও গ্রামের খোলা মাঠে মাঁচার উপরে বসে যে মনে শান্তি,তা আকাশ পাতাল তফাৎ, গ্রামের পরিবেশটা অনেকটা শান্তির আর মানুষগুলোর মনটাও সরল, আর সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি এই কয়েক বছরে বেঙ্গালুরুতে থেকে।
     সন্ধ্যের সময় মায়ের জন্য একটা তাঁতের হালকা লাল রঙের শাড়ি ও বাবার জন্য সাদা জামা,ও প্যান্ট কিনলাম। তারপর পঞ্চমী,আর ষষ্ঠীর দিন কলকাতাতে ঘুরে বেরিয়েছি মা-বাবাকে নিয়ে। সত্যি বলতে খুব খুশি হচ্ছিল সেদিন, মনে মনে ভাবছিলাম আজ আমি বড়ো হয়েছি, মা-বাবাকে নিয়ে ঘুরছি কলকাতার বুকে ঠিক যেভাবে ছোটবেলাই মা-বাবা আমার হাত ধরে ঘোরাতো মেলার মাঠে। 
   অষ্টমীর দিন সকাল থেকেই বাড়িতে উৎসব উৎসব মেজাজ। দিদি-মাসি আরো অনেকে এসেছেন। কেও লুচি বেলছেন বা কেও পায়ে আলতা দিতে ব্যস্ত। আমার সদ্য কেনা হলুদ পাঞ্জাবিটা পড়ে বেরিয়ে পড়লাম পাড়ার পুজো মন্ডপে, পেটে তখন ছুচো ডাকছে। মন্ডপে তখন ভীড় কম, সেখানে উপস্থিত থাকা ছেলে বলতে আমি আর আমার বাল্যকালের বন্ধু অর্ক। অর্ক এখন প্রফেসর । কলকাতার একটা কলেজে পড়ায়। অর্ক আমার থেকে একবছরের বড়ো। আর এই বছরেই তিরিশে পা দিলো অাগস্টে। ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো, বাড়ি ফিরলে ট্রিট হিসাবে দুই বোতল দামী বিয়ার। কথামতো সপ্তমীর দিন রাতেই দুই বোতল বিয়ার আমাদের বাড়িতে বসে খায়িয়েছে। তবে বিয়ার ছাড়া অন্য কোনো নেশা করিনি আমি, আর অর্কও আমার সাথে এই প্রথম বিয়ার খেল।
      মন্ডপে আমি আর অর্ক যখন বসে বসে মোবাইলের স্ক্রিনে মনোনিবেশ করেছি,ঠিক তখনই একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে আমার পিছনে এসে  হাটাহাটি করছে। বয়স চার বা সাড়ে চার বছর হবে হইতো। পায়ের জুতো জোড়ার বাঁশির প্যাক-প্যাক করে তীব্রভাবে আওয়াজ আমাকে সত্যি বিরক্ত করে তুললো। হঠাৎই অর্ক বড়ো বড়ো করে চোখ পাকিয়ে ছোট্ট  মেয়েটিকে ডাকলো। আর ডাকার সাথে সাথেই হঠাৎ আস্ত মেঘ ভেঙে পরার মতোন করে হাও মাও করে কাঁদতে থাকলো মেয়েটি। সত্যি বলতে আমি বাচ্চাদের প্রচুর কাঁদিয়েছি ইচ্ছা করে, যেমন আকাশে ওড়ার নাম করে প্যান খুলে দিই, মিথ্যে জুজুর ভয় দেখিয়ে মজা করি। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্য ছোট্ট ৪ বছরের মিষ্টি একটা মেয়ে যে কিনা অর্ক একটু বকতেই হাও মাও করে কেঁদে দিল, চোখে জল ছলছল করছে, মিষ্টি মুখটা লাল হয়ে উঠলো। সত্যি বলতে আমিও ভিতর ভিতর কেঁদে উঠলাম কেন জানি না। মেয়েটিকে কোলে নিয়ে জরিয়ে ধরলাম, কান্না থামতে বললাম। মিষ্টি গুলুগুলু মুখটা লাল হয়ে গেছে। অর্ককে দেখলেই কেমন ভয় পেতে থাকলো। নাম জানতে চাইলাম ও বললো- ' আমান নামম.. সন্ধ্যা', খটকা লাগলো মর্ডান যুগে এমন পুরোনো পুরোনো কেও নাম রাখে নাকি। যাইহোক সন্ধ্যা নামটা নিয়ে ইতিহাস আছে আমার। প্রিয় কয়েকটা নামের মধ্যে অন্যতম।  মিষ্টি সন্ধ্যা, মেয়েটাকে কোলে করে মন্ডপ থেকে বাইরে বেরোতেই হঠাৎ মেয়েটি মা... মা... বলে চিৎকার করতে লাগলো। আর তারপরেই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা।
        আমার দিকে হেঁটে আসলো মেয়েটির মা। দূর থেকেই চিনতে পেরেছিলাম। আর চিনবোই না কেন! যাকে ছোট থেকেই চিনি তাকে ভোলার নয় যে। আমার কোলে তখনও মিষ্টি সন্ধ্যা, বাচ্চা মেয়ে সন্ধ্যা ওর হাত দিয়ে শুধু আমার দাড়ি টানছে আর পাঞ্জাবীর কলার চিবাচ্ছে। তবে সেদিকে আমার খেয়াল নেই একটুও। আমি থমকে গেলাম কিছু সময়ের জন্য। আমার সম্পুর্ন শরীর কাঁপতে শুরু করলো কেনো জানিনা। আমার সামনে হঠাৎ এক অনন্যা এসে উপস্থিত হলো। হ্যা! অনন্যা ও এক অনন্যা। আমার অনুপ্রেরণায় উৎস ।
~ *আরে শ্রীমাযে....! কে বলতো আমি ? চিনতে পারলি আমাকে?*
~*ভুল যদি না বলি! তুই সুজন?*
~*আরে... চিনলি কিভাবে? 'সেই দিনে'এর পর এতবছর কেটে গেছে! আর তারপর আমাদেরতো আর দেখাও হয়নি?*
~*সেই দিন?....ওহ বাদ দেনা ওসব কথা.... আর বল কেমন আছিস? তোর অফিসের খবর কি?*
~*আমি কেমন আছি!! হা হা হা....তুইতো ভালোই আছিস? বিয়ে করলি কতদিন হলো?*
~ *এইতো ৫ বছর... তুই বিয়ে করেছিস?*
~ *হি..হি...বিয়ে?হুম.... বারো বছর আগে যে নামটাকে বুকের মধ্যে জায়গা দিয়েছিলাম সেই নামটাকেই আজো ভুলতে পারলাম না..আর বিয়ে।*
(এরপর শ্রীমার গোল মিষ্টি মুখটা কেমন লাল হয়ে উঠলো...)
~*আচ্ছা! তুই আমাকে চিনলি কিভাবে ?*
~ *তুই আমাকে ভুলে যাবি। তাইবলে আমিও ভুলে যাবো? যদি বলিস কিকরে চিনলাম......তবে শোন তোর চোখ আর নাকটা যে আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে....*
(শ্রীমা আমার ডান হাতের দিকে তাঁকিয়ে অবাক হোলো...)
~ *সয়তান! থাম তুই... বারো বছর আগের আমার দেওয়া আংটিটা আজো পড়ে আছিস? কি জন্য?*
~ *আজো না, সারাজীবন থাকবো রে....তবে সত্যি কি আমার অপেক্ষায় কোনো অন্যায় ছিলো?*
       এরপরেই আমাদের মেয়ে। নানা ভুল বললাম। শ্রীমার মেয়ে সন্ধ্যাকে শ্রীমার কোলে তুলে দিলাম। আর তারপরেই লক্ষ করলাম, একজন ৩৫-৩৭ বছরের বেশ লম্বা চওয়া লোক লাল চকচকে ইন্ডিকার দরজা খুলে অপেক্ষা করছে শ্রীমা ও সন্ধ্যার জন্য। সন্ধ্যা বাবা বাবা করে চিৎকার করতে করতে গুড়িগুড়ি পায়ে প্যাক প্যাক জুতোর আওয়াজ করে এগিয়ে গেল লাল ইন্ডিকার পাশে অপেক্ষারত লোকটির কাছে।
~*ওইযে আমার বর। আইএস অফিসার।*
~*বাহ! আচ্ছা শ্রীমা আমাদের দেখা হওয়া কি অনেক দেরিতে হয়ে গেল? নাকি সত্যিই সম্ভব ছিল না?*
~*চুপ করনা, ওসব কথা ভুলে যানা সুজন.... আর হ্যা ভালো থাকিসরে.....আজ আসি! সন্ধ্যার বাবা ডাকছে .....*
       কিন্তু যখনই পিছনে ঘুরলো শ্রীমা,তার একটু আগেই আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমার চোখ পড়লো শ্রীমার গলার লকেটির উপর। হ্যা! লকেটটা আমারই দেওয়া, ১২ বছর আগে গ্রামের মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলাম ২ টাকা দিয়ে লকেটটা। হ্যা! সেই লকেটটাই ঠিক চিনেছি আমি। আমার সমস্ত শরীরের ভর শুন্য মনে হতে লাগলো। বুকের ভিতরের শব্দ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।  প্যান্ডেলের একটা কোনায় দাড়িয়ে অতীতেরর দিনগুলোর কথা মনে পড়তে থাকলো।  বট গাছের নীচে দাড়িয়েই আমি নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছিলাম শ্রীমাকে লকেটটি। চোখ বুঝতেই চোখে জল চলে এলো।একে একে মনে পড়লো এক বিকালে দুজনে মিলে নদীর ধারে বসে বলেছিলাম আমাদের মেয়ে হলে তার নাম কি হবে! আমি বলেছিলাম 'সন্ধ্যা'। দুজনে মিলে শপথও করেছিলাম আমরা কখনও আলাদা হবো না।  একে একে প্রশ্ন ভেসে আসলো আমার মনে মনে। আচ্ছা শ্রীমা বিয়ের পরেও কেন লকেটটা আজো পরে আছে? কেনই বা ওর মেয়ের নাম সন্ধ্যা,এত নাম থাকতে?  কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। তারপর হঠাৎ অর্ক পিঠে হাত রেখে বলে উঠলো
- *'তোদের সব কথা শুনলাম! তবে তুই ওকে চিনলি না..'*
- *চিনলাম না মানে?*
- *তুই বেঙ্গালুরু যাওয়ার পর থেকে প্রতি বছরে আমার কাছে কতবার তোর খবর নিয়েছি তার ঠিক নেই। ওহ আমাকে প্রমিস করিয়েছিলো যে তুই যেন না জানিস এসব বিষয়ে...সরি রে....*
           ধিরে ধিরে মন্ডপে ভিড় বারতে শুরু করলো। মাইকে পুরোহিত মশাই হাকছেন অঞ্জলি দেওয়া এক্ষুনি শুরু করবেন তাই। শতাধিক মানুষের ভিড় সকলে অঞ্জলি দেবে। আর তাই চিৎকার, ভিড় থেকে নিজেকে শান্তনা দিয়ে রুমাল দিয়ে চোখটা মুছে শ্রীমাকে খুজতে শুরু করলাম কিন্তু পেলাম না...
*সত্যিই ও খুব অভিমানি....খুব অভিমানি..*
                             :::::::সমাপ্ত::::::
===================================
কপিরাইট :- *©প্রসেনজিৎ পাল*
18/05/2018
     

1 comment:

Powered by Blogger.