ছাঁচপিঠে

তিনটি নারী। একটি তরুণের জীবনে তাদের উপস্থিতি। কিছুটা নস্ট্যালজিয়া... এই নিয়ে রইল একটি সম্পূর্ণ গল্প। পড়বেন.. আশা করি সবার ভালো লাগবে।

*॥ছাঁচপিঠে॥*
           ~ *স্বপ্নময়*

*॥১॥*

১৪ই জানুয়ারী, ২০১৮,
বারাসাত

কেএফসি থেকে বেড়িয়ে এলো রোহন আর অনীতা। বাইরের আকাশটা লালচে হয়ে এসেছে। বারাসাতের উঁচু বিল্ডিংগুলির সুবাদে সূর্যের দেখা মেলা ভার। এখানে আকাশের রং দেখেই সময় অনুমান করে নিতে হয়।

পকেটে যা টাকা ছিল পুরোটাই রোহনের আজ ভোগে গেছে, তবে কোনো বান্ধবীকে খাওয়ানোর সময় সেসব না ভাবাই শ্রেয়। ফসল পেতে হলে একটু বীজ তো কিনতেই হয়।

-"থ্যাংক ইউ রোহান.. ফর সাচ আ ট্রীট..."

-"আরে, ফ্রেন্ডশিপ মে নো থ্যাংকিউ.. তাহলে তোকে বাড়ি পৌছে দিই চল।"

-"নারে, লাগবে না। আমার ড্রাইভারকে ফোন করে দিয়েছি... ওই তো আসছে.."

একটা অ্যাম্বাসেডর ওদের দিকে এগিয়ে এলো। অনীতা তাতে চড়ে উঠতেই রোহন নিজের পথে এগোলো।

রোহনের বন্ধু সুশীল ওখানেই ছিল। বলা ভালো পুরোটা সময় রাস্তার ওপাশ থেকে দুইজনকে নিরীক্ষণ করছিল সে। অনীতা চলে যেতে সে রোহনের কাছে গেলো।

-"আরে, সুশীল, খবর কি ভাই?"

-"আমার খবর পরে হবে, তোর একটু খবর নেওয়ার ছিল।"

-"কোনো এনকোয়্যারি?"

-"হম.. বহুদিন এক কাপ চাও খাওয়ায় না যে ছেলে সে আজ কেএফসিতে সুন্দরী সমেত?"

-"আরে ট্রীট ছিল।"

-"ট্রীট নয়, বল ডেট ছিল।"

-"হয়তো.. সেরকমটাই। তবে মেয়েটা অ্যাক্সেপ্ট করে নেবে আর কদিন বাদেই মনে হয়।"

-"আর বিদিশার কী হবে?"

নামটা সুশীল তুলবেই এটা রোহন জানত। একটু অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিল নিজেকে।

-"কি জানি!.. কথা হয় না আর ওর সাথে।"

-"কিন্তু তোর তো কথাই ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং-টা পেলেই মেদিনীপুর যাবি দেখা করতে?"

-"যাবো না আর। লাভ নেই, মেয়েটাকে বুঝিয়েছি.. লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনসিপ গুলো ইনফ্যাচুয়েশন মাত্র।"

-"শহরের জল পেটে পড়ে সব বদলে গেছে... বুঝতে পেরেছি। নেহাত গেঁয়ো মেয়ে বলে.. এড়িয়ে যাওয়াটা খুব সোজা..."

-"সিগারেট খাবি?"

রোহন পকেট থেকে গোল্ড ফ্লেকের একটা প্যাকেট বেড় করল। নিজে একটা সিগারেট নিয়ে সুশীল কে এগিয়ে দিল।

-"না.. আমি স্মোক করি না।"

-"কর.. ভালো লাগবে।"

-"থাক। আমি আসি।"

-"আয়।"

সুশীল ফুটপাথ ধরে সামনে চলতে থাকল। রোহনের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, সিগারেটের ডগায় আগুন ধরিয়ে দিল...

"বিদিশা"..নামটা এইসব টোবাকো প্রডাক্টের গায়ে লেখা "Smoking Causes Cancer" -এর মতন। শুনতে ভালো লাগে, তবে নিষ্প্রয়োজন।

না, তাকে ভালো লাগত বটে। তবে ভালো লাগাটুকুই। সামনে থেকে প্রেম করাটা আলাদা.. আর ফেসবুকে টেক্সট করে করাটা আরেক।

হুর.. ওসব মেয়েদের বিশ্বাস করতে নেই অত। বরং এখানে অনীতার সাথেই সুখে আছে। মেয়েটা বিদিশার মত সুশ্রী নয়.. তবে বডিশেপটায় পুষিয়ে দেবে। তাছাড়া ওর স্ট্যান্ডার্ডের.. স্মার্ট, সেম ডিপার্টমেন্ট, ক্লাস ফ্যামিলি...

নিজের মতামতটুকু বিদিশাকে ফোন করে জানিয়েছিল রোহন। মেয়েটি খুব কেঁদেছিল সেদিন। রোহন ভেবেছিল, হয়তো কয়দিন কল, টেক্সট করে জ্বালাবে সে। কিন্তু কোনো কলব্যাক আসেনি। মেসেঞ্জারে কোন অতলে হারিয়ে গেছে সে.. আর খবর রাখেনি রোহন।

তিন মাস তো কেটেই গেছে। বিদিশা এলাকারই কোনো ছেলের সাথে হয়তো পিরিত করছে এখন। না করলেও, ওইসব প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের বিয়ে হতেই বা কতটুকু দেরী?

ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ভাবনাগুলো ছড়িয়ে পড়ে.. নিকোটিন ফুরোয়.. গল্পেরই মতন।

*॥২॥*

১৪ই জানুয়ারী, ২০১৮,
সন্ধ্যে ৭টা,
বারাসাত,

ঠাণ্ডা খুব পড়েছে। স্নান করবার ইচ্ছে না থাকলেও মায়ের তাড়নায় যেতেই হল। শাওয়ারের ঊষ্ণ জলটুকু ছেড়ে দিয়ে গুনগুন করতে থাকল রোহন।

এই সময়টুকু ওর বড্ড নিজের। সিগারেটের ধোঁয়াটা একান্তে যেমন কিছু হতাশা কেড়ে নেয়, তেমনি স্নান ঘরের বাষ্পটুকু শরীরে অনেক সুখ এনে দেয়।

ওদের থেকে অনীতাদের স্নানঘরটা অনেকটাই বড়ো। বলা ভালো ওর পার্সোনাল বাথরুম। ভিতরে কি কি আছে, সেটা যদিও দেখা হয়নি। ঘরে ঢুকতেই রোহন বেডে বসতে চেয়েছিল.. অবশ্য অনীতা বাইরের পোশাকে তাকে বসতে দেয়নি। তার জন্য চেয়ার এনে দিয়েছিল।

রোহন সেখানে বসতেই সে ওর সামনে জ্যাকেটটা খুলে রেখে বাথরুমে ঢোকে। সেই রুমের ওপরটা স্বচ্ছ কাঁচের। অনীতার মাথাটুকুই দৃশ্যমান। সে একটু করে তার কাপড় খুলছিল.. টেপ.. ব্রা...

অনেকটা আকন্দফুলের মতই সে রূপ.. গর্ভাশয়টুকু লুকিয়ে পাঁপড়িগুলো যেন মেলে ধরেছে, কোনো পতঙ্গকে আকৃষ্ট করতে।

কাঁচের স্বচ্ছতা বাষ্পের ঘনঘটায় বিলীন হল।

-"কি রে? স্নান হল?"

মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরল রোহনের।

-"হ্যাঁ.. এই হয়ে গেছে।"

শাওয়ারটা বন্ধ করে গামছা দিয়ে নামমাত্র গা-মাথাটুকু মুছে সেটা কোমরে জড়িয়ে বেড়োলো সে। উফ...! বাষ্পের উষ্ণতা হাপিস.. কি ঠাণ্ডা!

দ্রুত ঘরে গিয়ে খাটের একপাশে রাখা শার্ট,বার্মুডা, শোয়েটার-গরম প্যান্টটা পড়ে নিয়ে খাটে বসে পড়ল। একটু সময় ফেসবুকটা ঘাঁটবে.. এই আর কি!

-"মা.. কিছু খেতে দেবে না?" রোহন ডাক দিল।

মা আজকাল সব কথার একটু দেরীতে জবাব দেন। কানের সমস্যা তো আছেই। তাছাড়া উনি অন্য আরেক কারণে মন মরা।

বছর ঘুরে এলো রোহনের দিদিমা আর নেই। বয়স তেমন হয়নি.. তবে প্রকৃত প্রেম ও স্ট্রোক -দুটোই কখনও বলে-কয়ে আসে না।

দিদিমার সবথেকে কাছের নাতি ছিল রোহন। রোহনেরও সব আবদারের জায়গা ছিলেন তিনি। শৈশবটা তার দিদিমার গ্রামের বাড়িতেই কেটেছিল, যখন তার বাবা ট্রান্সফার হয়ে সবে মাত্র মফস্বলের দিকটায় এসেছেন। পরে বারাসাতে জমি-জায়গা কেনা হয়ে গেলে রোহনকে দিদিমার কাছ ছেড়ে এদিকটা আসতেই হল।

তবে বয়স বাড়বার সাথে সাথে অনেক কিছুই তো বদলায়। দিদিমা গত পৌষপার্বণেও যখন ওদের বাড়িতে ছাঁচপিঠে নিয়ে এসেছিলেন রোহন তখন তার তোলা গ্রুপ সেলফিতে বন্ধু-বান্ধবদের ট্যাগ করতে ব্যস্ত।

-"কেমন আছো বাবুসোনা?"

-"ভালো আছি দিদা, তুমি?"

রোহন ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করেছিল। জবাবে তার দিদিমা মিষ্টি করে হেসেছিলেন।

সেই ছিল দিদিমার সাথে তার শেষ কথা। নিয়তি দুজনের কথোপথনের জন্য আর কোনো পাতা রেখে যায়নি...

যাই হোক, মা এখনও সাড়া দিল না? শুনতে পায়নি নাকি?

-"ও মা?.. শুনতে.."

রোহনের কথা পুরো না হতেই ওর মা ঘরে ঢুকলেন। মেয়েরা সাধারণত কোনো কারণে ভেঙে পড়লে খুব চুপচাপ হয়ে আসে। হ্যাঁ এটা খুব আশ্চর্যের যে দুঃখের মুহুর্তগুলিতে পুরুষ স্তদ্ধ হয়, কিন্তু নারী কেবলই নীরব থাকে।

মায়ের হাতে বাটি ভর্তি কি যেন। রোহন উঁকি মেরে দেখল..

-"ছাঁচপিঠে? কে পাঠালো?"

-"তোর ছোটো মামী।"

-"বাহ.. দাও তো..."

-"গরম আছে, মাইক্রোওয়েভে দিয়েছিলাম।"

বাটিটা হাতে নিল রোহন। দিদিমার মৃত্যুর পর ছাঁচপিঠে কেউ পাঠাবে সে আশা করেনি। মামী-কাকিদের যত্ন আত্তির কোনোদিনও মা-মাসি-পিসি-দিদিমায়েদের মতন হয় না.. এটা বাঙালির ঘরে বহুপ্রাচীন রীতি। ওই ছড়ায় বলে না, "মামী এলো লাঠি নিয়ে/ পালাই পালাই"।

বড়ো মামী পাঠাবে না, রোহন জানে। ওনারা একটু উচ্চবিত্ত পরিবার, ঠিক অনীতাদের মতন। ছোটোমামার নেহাত একটা মুদির দোকান বলে ছোটোমামীরও কোনো উচ্চাশা নেই। ওনারা অক্লেশে যেকোনো কিছু বিলিয়ে দিতে না পারলেও, ওনাদের দেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল।

ছাঁচপিঠেটা একটু ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে মামী সেগুলোতে ধনেপাতা দিয়েছে। রোহন একটা নিয়ে কামড় বসালো..

-"উম.. ভালো, তবে ঝাল নেই কেনো?"

-"ও তো জানে তুই খুব ঝাল পছন্দ করিস। তাই হয়তো লংকা কুঁচি বেশি দেয়নি।"

-"ধুস.. কীরকম একটা খেতে যেন.."

-"সবাই কি আর তোর দিদার মত তোর পছন্দগুলো বোঝে?"

-"তুমি বোঝো তো। কটা পিঠে তো করতে পারো।"

-"আচ্ছা করবখনে। তা, তুই ওটা খেতে পারছিস কি?"

-"না.. সে খেতে পারছি। তবে ঝাল ঝাল ছাঁচপিঠে না হলে ঠিক মন ভরে না। তুমি খাবে না?"

-"না, আরো আছে। একবারে গরম করিনি। তুই খা।"

মায়েরা সবসময় এরকম কথাই বলে। ওনারা অন্নপূর্ণা কিনা রোহনের জানা নেই, তবে ঈশ্বরী পাটনী সকলেই।

মা-দিদিমার প্রভাব অনেকটাই ওর জীবনে। এমন একটা ভালোবাসা.. যেটা হয়তো নিজ মৃত্যুর আগে অবধি সে পেতে চাইবে।

*॥৩॥*

জানুয়ারী মাস, ২০১৬,
দুপুর বেলা,
ঝাড়গ্রাম,

প্রচণ্ড শীত। এই সময় মেদিনীপুরের দিকটায় এমনিতেই ঠাণ্ডা থাকে খুব। আর ঝাড়গ্রাম তো বাংলার চরমভাবাপন্ন শহরগুলির একটি.. মাঘের ঠাণ্ডায় বাঘেরও হাড় হিম হয়ে যাবে।

-"স্নানটা করে আয় যা.. অনেকটা পথ এসেছিস, সারা গায়ে ধূলোবালি জমেছে।"

-"উফ.. করতেই হবে?"

-"হ্যাঁ.. করতেই হবে।"

কথোপকথনটা তখনকার যখন এগারো ক্লাসে পড়ছে রোহন। ঝাড়গ্রামে এককালে বাবা ট্রান্সফারের কারণে এসেছিলেন, সেসূত্রে অনেক লোকের সাথেই এখানেই ঘনিষ্ঠতা। তাই এখন চব্বিশ পরগণাতে পুরোপুরি শিফ্ট হয়ে গেলেও বিজুকাকাদের বড়ো মেয়ের বিয়েতে রোহনকে আসতে হয়েছে।

স্নান করবার ইচ্ছেটুকু ছিল না ওর। কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে করতে হচ্ছে। কাকিমণিও তার ছোটোমেয়েকে বলে উনুনে গরম জল বসিয়েছি।

হ্যাঁ, উনুনই। তখনও ঝাড়গ্রামের সকল জায়গায় এলপিজি পৌছয়নি.. বা পৌছলেও তা বিজুকাকাদের কাছে খরচসাপেক্ষ ছিল। রোহন রান্নাঘর লাগোয়া উনুনের দিকে এগিয়ে এলো।

সে দেখছিল, একটি মেয়ে চুপটি করে করে উনুনের ভেতর আগুনে একটার পর একটা শুকনো পাতা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মোটা একটা পাট কাঠি দিয়ে সেটা নেড়ে নিচ্ছে।

রোহন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। প্রথমত উনুন জিনিসটা সে খুব মিস করে এখন। সেই ছোটোবেলায় যখন দিদিমার কাছে থাকত, উনিও এরকম উনুনে শুকনো পাতা দিতে দিতে রোহনকে নামতা শেখাতেন।

অবশ্য পিছন থেকে মেয়েটিকেও দেখতে বেশ লাগছিল ওর। বয়স তখন সবে ষোলো, বাবার কড়া শাসনের কারণে খুব একটা বান্ধবী-সংস্পর্শ ছিল না ওর। তাই যতক্ষণনা উনুনে জল গরম হচ্ছে মেয়েটির কাছে দাঁড়িয়ে থাকাটা উপভোগ করছিল সে।

কাজটি করতে করতে মেয়েটি একটু পাশ ফিরেছিল। ওর চুল খোলা.. খুবই দীর্ঘ... এবং টানটান। ওর গায়ের রং একটু চাপা.. তবে চোখ-নাক-মুখ... অপূর্ব!..

বয়স বারো-চৌদ্দর ছেলেদের কাছে নারী শরীর সবচাইতে বড়ো রহস্য। বিশেষত বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলাদের স্তন-নিতম্বের গড়ন তাদের আকর্ষণ করেই।

তবে একটা বয়স আসে তারপর, যখন সে কোনো না কোনো নারীর.. বিশেষত সমবয়সিনীর মুখমণ্ডলে মোহিত হয়। ক্ষণেকের জন্য হলেও প্রেমে পড়ে।

উনুনে জল গরম হয়ে এসেছে। মেয়েটি হাঁড়িটা তুলে আগুন নিভিয়ে দিল। এতক্ষণ বাদে সে সরাসরি রোহনের চোখে চোখ রেখেছে। খুবই ভাবলেশহীন সেই চাহুনি।

গ্রামাঞ্চলের দিকের মেয়েরা অনেকটা ওরকমই। ওরা শৈশব থেকেই পুরুষদের দেখতে অভ্যস্ত। শহরের মেয়েদের মত ঘরে আসা অতিথি তরুণটি তাদের মনে আকর্ষণ আনলেও, আগ্রহ আনেনা।

-"তুমি কোন ক্লাস?" মেয়েটি ওর সাথে যেচে কথা না বলায় রোহন নিজেই শীতলতা ভাঙল।

-"সাড়ে এগারো।"

-"সেটা কি?"

-"কদিন বাদেই ফাইনাল এক্সাম, তাই।"

-"ওহ.. আমিও।"

-"জানি।"

মেয়েটি যে স্বল্পভাষী, সেটা বুঝতে বাকি রইল না রোহনের। সত্যি, বাড়ি থাকতেও বাবার দাপটে বান্ধবীদের সাথে কথা বলা হয় না, আর এখানে ফাঁকা মাঠে বলে পা দেওয়া যাবে না.. সত্যি!

-"কল পাড়ে আসো।"

-"তুই করেই বলতে পারো.. মানে পারিস।"

-"আয়।"

মেয়েটি তার ওড়নায় করে হাঁড়িটা ধরে একটা লোহার বালতিতে কিছুটা জল ঢাললো। রোহন মেয়েটির পিছু নিয়ে চলল। রান্না ঘরের লাগোয়া স্নানঘর। অবশ্য সেটা ঘর নয়... কলপাড় মাত্র। দুদিকে দেওয়াল ও বাকি দুদিক টিন দিয়ে ঘেরা। ওপরে কিছুই নেই.. পাশে থাকা পলাশ গাছটি দেখা যাচ্ছে। এখানে বাড়ির ছেলে মেয়েরা সকলেই স্নান করে।

সে লোহার বালতিতে কল পাম্প করে কানায় কানায় জল দিয়ে ভর্তি করে দিল। শীঘ্রই একটা মাঝারি উষ্ণতায় চলে আসবে বালতিটা।

-"এখানে স্নান করব?" রোহন উপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

-"হম.. গামছাটা দেখ কলের ওপর রাখা। পাশে দঁড়ি আছে.. জামা-কাপড় খুলে রাখিস।"

-"আচ্ছা বেশ। তা তুই একটু বেড়ো।"

-"না.. আমাকে আমি কাপড় কাচবো।"

কলের কাছে একটা বালতিতে সাবানে কিছু জামা-কাপড় ভেজানো। মেয়েটা গিয়ে সেখানে বসল। পড়নের চুড়িদারটা একটু সামনে নিল।

ওর কোমরটা যে ঢেউ খেলানো.. এতক্ষণে বোঝা গেল। গ্রামের মেয়েদের শরীরে এমনিই পুষ্টির অভাব.. তারওপর পোশাক তো ধুতরো ফুলোর মত। পুরোটাই ঢোলা কাপড়ে ঢাকা।

-"কিরে? তাকিয়ে আছিস কেনো? স্নান কর।"

-"আরে তুই না গেলে স্নান করি কি করে?"

-"ল্যাংটো হবি?"

-"অ্যাই কি সব বলছিস?" রোহন লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেল।

-"হতেই পারিস.. বাচ্চা ছেলেই তো।"

-"না.. বাচ্চা নই মোটেই। তাই তো বলছি.. তুই যা, কাপড় ছাড়বো।"

-"আর এই জামাগুলো কে কেচে দেবে শুনি?"

-"কিন্তু.."

-"এই বোকা, ছেলে মানুষ না তুই?.. জামাটা খোল। গায়ে মগে করে জল দে। তারপর গামছাটা কোমড়ে দিয়ে প্যান্ট-জাঙিয়া খুলে ফেলে ঘরে যা।"

-"এতো কিছু করতে হবে?"

-"বেশি বকিস না তো। জলদি স্নানটা সার। বিন্টি আর বুবলুকেও স্নান করাতে হবে এরপর। জলটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যে.. নে তাড়াতাড়ি কর.."

-"আচ্ছা.. করছি..."

মেয়েটির কথামতো জামাটা খুলে গায়ে জল দিল।

-"উফ.. কি ঠাণ্ডা!"

রোহনের দাঁত কিড়মিড় শুনেই মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলল। বড্ডো মধুর সেই হাসি।

কয়েক মগ জল ঢালার পর রোহন সাবান খুঁজল। না, মেয়েটাকে বিরক্ত করতে হয়নি। দিদিমার বাড়িতে থাকতেই সে জানত গ্রামাঞ্চলে লোকজন কলের গায়েয় কিছটা সাবান লেপে রাখে। সেখান দিয়ে হাত ঘষে মাথায় মেখে নিল ও।

বেশ ফেনা হল। গ্রামের জলে খরতা কম, তাই সাবানের ফেনা বেশি হয়.. রোহন জানত। সেই দিয়ে গালে-মাথায় লাগালো সে। হাল্কা দাঁড়ি সবে উঠছে.. তার ওপরে ফেনা মেখে নিয়েই সে মেয়েটির দিকে তাকালো,

-"দ্যাখ, রবীন্দ্রনাথ সেজেছি।"

মেয়েটি কাপড় কাচতে কাচতেই খিলখিলিয়ে হাসল। রোহনের মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতরে হঠাত কে যেন একটা টান দিয়েছে!

-"এবার শিব ঠাকুর হো তো।"

-"সেটা কি করে হয়।"

-"দাঁড়া দেখাচ্ছি।"

মেয়েটি হাত ধুয়ে স্নানের মগটায় জল ভরে নিল। নিয়েই রোহনের মাথায় মগটা উল্টো করে চেপে ধরল।

মাথার থেকে ছড়িয়ে পড়া জলের রেখায় ক্রমশঃ মুখের ফেনাটুকু সরে যেতে লাগল। রোহন খুব কাছ থেকে মেয়েটির চোখ মুখ দেখছে...

...ও দুটি হাত উঁচু করে রোহনের মাথায় মগটি চেপে ধরে আছে.. ওর সরু শরীরটি খুবই নিকটে.. চুড়িদারের আড়ালে এখনও যৌবন ফোটেনি। কিন্তু তার থেকে একটা সুগন্ধ আছে.. যেটা ওর কিশোর মনটিকে আবিষ্ট করে দিয়েছে....

-"কিরে বিদিশা? বাবুকে স্নান করালি?"

রান্নাঘর থেকে কাকিমণির গলা শোনা গেল। মেয়েটি মগ রেখে ছুটে গেল কলের কাছে। ফের তার কাজে মন দিল।

রোহনও কিছু বলল না আর। স্নানটুকু সেরে গামছা পড়ে বেড়িয়ে এলো।

নতুন জামা-কাপড় পড়ে সে ছাদে চলে গেল রোদ পোহাতে। ছাদটা ন্যাঁড়া। পাশের পলাশগাছটি তার মাথাটা একগুঁয়ে খোকার মতন এগিয়ে দিয়েছে। সেই ছায়ার পথ ধরেই রোহন ছাদের প্রান্তে গেল।

নীচে কলপাড় দেখা যায়। মেয়েটা এখনও কাপড় কাচছে। ওই যে.. কলপাড় লাগোয়া ছোট্ট টয়লেট থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বেড়িয়ে এলো।

মেয়েটা ওকে কলপাড়ে বসতে বলল। তারপর তার ডান হাতে মগ ধরে জল ঢেলে বাচ্চাটির পিছনে বাম হাত দিয়ে পায়খানাটা মুছতে লাগল।

সত্যি, গাঁয়ের মেয়ে বলেই এতো খাটুনি পোহাতে পারে! ঠিক রোহনের মা-দিদিমায়েদের মতন। সেই ছোটোবেলায় কতবার তাদের ওপর মলত্যাগ করেছে.. বমি করেছে.. অথচ বিন্দুমাত্র না রেগে তারা তৃপ্তি ভরা মুখে সেটা পরিষ্কার করে দিতেন।

না, ভালো লাগার মত মেয়েটি.. নাম কি যেন?.. ওহ! বিদিশা!

*॥৪॥*

জানুয়ারী মাস, ২০১৬
বিকেল বেলা,
ঝাড়গ্রাম,

-"পিঠেটাতো দারুণ খেতে হয়েছে! মেয়ে তো দারুণ রাঁধে!"

-"হ্যাঁ, ও রান্না করতে খুবই ভালোবাসে।"

বারান্দায় সকলে সারি করে আসন পেতে খেতে বসেছে। শেষ পাতে বিদিশার হাতের তৈরী পুলি পিঠে খুব প্রশংসা কুড়িয়েছে।

-"ইস্.. কি মিষ্টি!.. ঝাল-টাল পারে না?"

-"চুপ কর! কিসব বলছিস!" রোহনকে কোনোমতে থামিয়ে ওর বাবা বললেন, "পিঠে কি আর ঝাল হয়?"

-"কোই দিদা তো করে.. লংকা কুচি দিয়ে..."

-"ওটা ছাঁচ পিঠে বোকা হাঁদা!.. নে, চুপ চাপ খা..." ছেলেকে ধমক দিয়েই তিনি বিদিশার দিকে ফিরলেন, "মা রে, কি অপূর্ব রাঁধিস রে.. ওর কথায় কিছু মনে করিস না.. খাওয়া শেখেনি এখনও।"

-"না না.. ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব।" মাথা নীচু করে লাজুক ভাবে হাসল বিদিশা, "জেঠু, আরেকটা নেবেন? বুঝে খাবেন কিন্তু, রাতে গুঁড় আর পিঠে নিয়ে আসবো কিন্তু।"

রোহন আর খেলো না। আধ খাওয়া পিঠেটা মায়ের পাতে রেখে দিয়ে উঠে পড়ল। কল পাড়ে গিয়ে হাত ধুয়ে আসতে হবে।

রান্নাঘর দিয়ে যেই মাত্র কলপাড়ে যাবে অমনি পাশ দিয়ে বিদিশা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো.. কোলে সেই ছোট বাচ্চাটা।

-"এই সর সর.. সত্যি, পেট খারাপ তাহলে এতো খাও কেনো বাপু?.. উফ.. শরীর খারাপ হয়ে যাবে.."

বাচ্চাটাকে নিয়ে বিদিশা টয়লেটের দিকে এগিয়ে যায়। রোহনও কলে হাত ধুতে ধুতে ভাবে, সত্যি মেয়েটা পারেও বটে!

*॥৫॥*

১৫ই জানুয়ারী, ২০১৭
সন্ধ্যে বেলা,
ঝাড়গ্রামের নিকটে,

সুবর্ণরেখা নদীটি শীতে অনেকটাই বুঁজে আসে। তবে সন্ধ্যের সূর্যের প্রতিচ্ছবি নদীর স্বচ্ছ জলে খুবই মায়াময় লাগে। ঠিক যেন কোনো কিশোরী ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে বসে তার কেশচর্চা করছে।

ঠাণ্ডা নেমেছে খুব। নদীর তীরে গায়ে সোয়েটার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। কথোপকথন চলতে চলতে বেলা গড়িয়ে এলো।

-"তুই পৌষ সংক্রান্তির দিন আসিসনি কেনো রে?"

-"ওই দিন দিদা বাড়ি আসে, পিঠে নিয়ে তাই।"

-"আচ্ছা, তা'লে ঠিক আছে।"

-"কেনো, মান করলি?"

-"না, সে করতে বয়েই গেছে।"

-"তাহলে?"

-"কিছু না।"

-"পেট খারাপে?"

-"চাল হাট!"

-"মন খারাপ?"

-"এই শোন.. ছাঁচ পিঠে করেছি.. লংকা-ধনে পাতা দিয়ে.. তবে পুড়ে গেছে একটু.."

-"মানে পেট খারাপটা আমার হবে?"

-"ধ্যাত.. ঘরে চলতো"

আগে লজ্জা পেলে বিদিশা মাথা নামিয়ে নিত। এখন সে মাথা ঘুরিয়ে উল্টো পথে রওনা হয়...

আজও তেমনি হল.. যদিও প্রতিবারের মতন রোহন তার হাতটা টেনে ধরল।

-"খুব মিস করিস বল?"

-"করি তো।"

-"ফেসবুকে তো ফ্রেন্ডেই আছিস। কলও তো করি।"

-"তাতে কি? গোটা বছর অপেক্ষা করেছি কবে এদিনটায় আসবি.. কবে ফের সামনাসামনি দেখবো।"

-"খিদে পেয়েছে.. বাড়ি চ।"

-"ফের কথা ঘোরাচ্ছিস?"

-"কে না ঘোরায় বল?"

দুজনের খুনসুটি চলতে থাকল। ধীর পায়ে তারা এগিয়ে চলল নদীর তীর ধরে। দূরে সূর্যের শেষ লালটুকু নীলে মিশে গেল।

*॥৬॥*

১৫ই জানুয়ারী, ২০১৮,
সন্ধ্যেবেলা,
বারাসাত,

সন্ধ্যের শহর। ঠাণ্ডায় ধোঁয়া-ধুলো জমাট বাধছে। চোখ-মুখ মাফলারে না ঢাকলে ফুটপাথ দিয়ে চলা মুশকিল।

তারওপর ভীষণ জ্যাম। গাড়িগুলো যেন সেই ক্লাসমেট যে চূড়ান্ত পেট খারাপেও স্যারের ক্লাস মিস করতে চায় না।

রোহন অনীতার সাথে ওদের অ্যাম্বাসাডরের ভেতরে বসে আছে। গাড়ি জ্যামে আটকে থাকায় অনীতা নিজের আইফোনটা ঘেটে চলেছে তখন দিয়ে। "Exhausted in Jam" ক্যাপশনে একটা সেলফি আপলোড করছিল সে।

-"সবসময় ফোন নিয়ে থাকিস। চোখ খারাপ হয় না?"

-"হয়েছিল। স্পেকসটা পড়ার সময় নিই।

-"সবসময় নিলে কিউর হতে পারে, তাছাড়া সেফটিও দেয়।"

-"হম।"

মেয়েটাকে ফোনে মগ্ন দেখে রোহন আর কথা বলল না। গাড়ির ভেতরটা কেমন বদ্ধ হয়ে এসেছে। বাইরে ঠাণ্ডা.. তবুও জানালাটা না খুললে দম বন্ধ হয়ে আসছে।

-"জানালাটা খুলি?"

-"হম।"

অনীতার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। রোহন উইন্ডো গ্লাসটা একটু নামিয়ে দিল। পাশে আরেকটি গাড়ির খোলা জানালা তার সামনে উন্মোচিত হল।

গাড়ি ভেতরে যে দৃশ্য সে দেখল, সেটা কাঙ্খিত ছিল না। এক ভদ্রমহিলা রীতিমত কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তার পাশে একটি সাত কি অাট বছরের বাচ্চা মেয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে চলেছে।

-"মা... কিছু হবে না গো... ডাক্তাররা কিছু পারেনি তো কি হয়েছে? ঠাকুর আছে তো.. তোমার কিছু হবে না... ঠাকুর.. তুমি মা কে বাঁচিয়ে তোলো..."

গাড়ির ভেতরে ভদ্রমহিলা পাগলের মত এই কথাগুলিই বারবার বলে চলেছেন। তার চুল উশকোখুশকো, চোখমুখ ফেলে দেওয়া সিগারেটের মত নিস্তেজ হয়ে এসেছে।

দৃশ্যটি দেখে রোহনের অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছিল।

প্রায় বছর এক আগে এরকমই একসময় সে বাড়িতে বসে সেমেস্টারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময়েই মামাতো ভাই ফোন করে সেই দুঃসংবাদটি দিয়েছিল।

দিদিমা যে নেই.. মা প্রথম চোটে বিশ্বাস করতে চাননি। তবে ফোনের অপর পাশ থেকে মামার কণ্ঠে কথাটা শোনবার পর, "মা.. হায় মা..." বলে চিৎকার করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন।

রোহন দিদিমাকে খুব ভালোবাসতো, কিন্তু সেদিন ওর কোনো কান্না পায়নি। প্রথমে মাকে সামলানো, কিংবা পরে মামাতো ভাইটিকে সামলানো.. কোনো কিছুই ওকে সেদিন কাঁদতে দেয়নি।

হ্যাঁ, কেঁদেছিল। যেদিন শ্রাদ্ধের দিন যখন সবাই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ব্যস্ত তখন ও একাকী দিদিমায়েদের গ্রামের খালপাড়ে এসে বসেছিল। ওর তখন খুব মনে পড়ছিল দিদিমাকে। মনে পড়ছিল দিদিমা যখন তাকে কোলে করে খালপাড়ে নিয়ে এসে পূর্ণিমার চাঁদ দেখাতেন।

ও কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এমন সময়ই একটা ফোনকল এলো। অনিচ্ছা সত্বেও পকেট থেকে ফোনটা বেড় করল.. বিদিশা।

-"ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব।"

-"দরকার না থাকলে আমিও ফোন করি না।"

-"কিছু বলবি?"

-"একটা অনুরোধ। আজকের বিকেলটা আমার সাথেই কথা বলে কাটা।"

-"কেনো?"

-"তোর সব খবর আমি রাখিরে। তুই কিছুতেই ভেঙে পড়িস না, আমি জানি। কিন্তু আজ অন্তত আমার সামনে ভেঙে পড়।"

...সেদিনের কথাগুলো আজ হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে রোহনের খুব মনে পড়ল। পাশের গাড়ির মহিলাটিকে দেখে ওর কষ্ট হচ্ছিল.. একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

মা প্রায়েই বলত, "যার মা নেই, সেই বোঝে জগত কতটা অন্ধকার।"

..এখন রোহন এটা খুব ভালো ভাবে উপলদ্ধি করেছে। ভেঙে পড়ার জন্য জীবনে একটি মানুষের খুব দরকার...

-"উফ!.. ডিসগাস্টিং!.. জানালাটা বন্ধ কর তো!.. তখন দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে.. একে জ্যাম, তারওপর দ্যাট লেডি!.. ক্লোজ ইট রোহান!"

অনীতার আচমকা এভাবে উত্তেজিত হওয়াতে রোহনও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। পাশের গাড়ি থেকে ওর কথাগুলো শুনতে পেলো নাকি?.. না পেলেও, এখুনি কোনো সিনক্রিয়েট যেন না ঘটে ভেবে চটপট উইন্ডো গ্লাস নামিয়ে দিল রোহন।

অনীতা তার বিরক্ত মুখভঙ্গিতেই ফের গাড়ির নরম শিটে হেলান দিয়ে আইফোনের স্ক্রিনটা খুলল। রোহনের এখন গাড়ির ভেতরটা আরো দম বন্ধ বলে মনে হচ্ছে। যেন কেউ তাকে টেনে হিঁচড়ে বলছে, নিলয়ের রক্ত টুকু যেন আর থামিয়ে না রাখে সে..

-"অনীতা, তোকে একটা প্রশ্ন করব.."

-"হম, আস্ক ইট।"

-"আমি ঝাল খেতে ভালোবাসি না মিষ্টি?"

-"এ কিরকম প্রশ্ন?"

-"তুই বল না.."

অনীতা বেশ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর রোহনের দিকে একটু উদাসীন হাসি হেসে নিল, ভেবেছিল হয়তো তাতে ওর জিজ্ঞাসাটাকে এড়ানো যাবে।

-"কিরে? অ্যানসার মি প্লিজ।"

-"উফ.. এসব আমি কি করে জানবো?"

-"আমি তো জানি তোর স্পাইসি ভালো লাগে। বলেই তো কেএফসিতে নিয়ে যাই।"

-"ও.. তোর সুইট ভালো লাগে, রাইট?"

-"রিয়েজন?"

-"কারণ যখন আমি ওখানে খাই, তখন তুই খুব কম অর্ডার করিস। তাছাড়া তোকে খুব সুইট দেখতে। তাই তুই নিশ্চয়ই স্পাইস নয়, সুইটই ভালোবাসবি?"

-"ঢেমনি.." নীচু গলায় বলল রোহন।

-"হোয়াট ডিড ইউ সে?"

-"নাথিং। বাই দ্য ওয়ে, নেহাত আমাকে তোর বিলটাও পে করতে হয়, সেজন্যই আমি কেএফসিতে নিজের জন্য সস্তায় অল্প কিছু অর্ডার করি।"

-"কিসব যাতাহ!" অনীতার চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। তবুও সে একটু হেসে নিয়ে বলল, "সো ফানি ইউ আর!"

হাসিটা খুব কৃত্রিম ঠেকছিল। রোহান হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে সেটা ভেজিয়ে দিল। সে জ্যামের ভেতর দিয়েই ফুটপাথের দিকে এগিয়ে চলল।

রোহনের আচমকা এরকম করাতে হয়তো গাড়ির ভেতর থেকে কোনো জিজ্ঞাসা তার জন্যেও ছুটে এসেছে। কিন্তু মোটা কাঁচের স্তর বড়োই শব্দ-নিরোধী হয়।

*॥৭॥*

১৫ই জানুয়ারী, ২০১৭,
ঝাড়গ্রাম,

"কখনো বিপথে যদি  ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
      অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।
..তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুব তারা.."

হারমোনিয়াম বাজানো থামালো বিদিশা। সামনে বিছানায় বসে রোহন। তার মুখে অনাবিল তৃপ্তি।

-"ভালো লাগল?"

-"না।"

-"তোর তো আমার কিছুই ভালো লাগে না।"

-"ভালো লাগেনি। তৃপ্তি পেয়েছি।"

-"সবসময় অমন ঘুরিয়ে বলিস কেনো? আমার মাথাটা এমনিতেই কাঁচা।"

-"সে মাথা নিয়েই তো উচ্চমাধ্যমিকে সাড়ে চারশো পেলি। আমি জাস্ট তিনশো চল্লিশ।"

-"তাতে কি? তুই তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিস।"

-"তুইও কমপিটেটিভ দিতে পারতিস। কেমিস্ট্রি অনার্স নেওয়ার ভূত কেনো মাথায় চাপলো?"

-"ভালো লাগে তাই। সমীকরণগুলোর মধ্যে জীবনকে খুঁজে পাই জানিস।"

-"কীরকম?"

-"..অনেকরকম.. যেমন ধর.. ব্রাউনীয় গতি.. গ্যাসীয় কণাগুলি সর্বদা গতিশীল। তারা যতই কারোর গায়ে ধাক্কা খাক, চরিত্র অপরিবর্তিত থাকে। মানুষের জীবনেও সকল পরিস্থিতি না থেমে নিজের মন-চরিত্রকে স্থির রেখে চলাটাই আসল।"

-"বাহ বাহ, খুব বুঝে গেছিস। বরং তোর কাছে কেমিস্ট্রিটা পড়লে হয়তো IIT -টাও পেয়ে যেতাম।"

-"শুধু আমার পিছনে লাগা? কি পাস সবসময় এমন করে?"

-"আসলে..."

-"নে নে.. অনেক গল্প হল.. পিঠে খাবে না বাবু?" বাটি হাতে কাকিমণি ঘরে এসেছেন। রোহন সেখান থেকে একটা ছাঁচপিঠে তুলে নিল, বেশ কালচে.. বোধহয় পুড়ে গেছে।

-"দেখে তো মনে হচ্ছে যেন পুরো অমবস্যার আকাশটা কেউ পেড়ে এনেছে.."একটা কামড় দিল রোহন, "...উম... ঝালটা আরো দিতে হত..."

-"মা! একে কিছু বলবে? ভালো কথা কি কিছু বলতে পারে না?"

-"সে আমি কি আর বলব? ও খুব লক্ষ্মী ছেলে.. নইলে ভালো লাগা-না লাগাগুলো কজনই বা সামনা সামনি বলে?" কাকিমণি রোহনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, "দাঁড়া বাবা, আমরা তো ঝাল কিছু রান্না করতে পারি না তেমন। তবে আজ মাংশ রেঁধেছি তোর জন্যে।"

রোহন এক গাল হাসল। সে খুব খুশি। যদিও কাকিমণি যখন ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন তার পড়নের ভুসো-কালি মাখা পুরোনো শাড়িটার দিকে চেয়েছিল।

-"বিদিশা, আমার জন্য খুব খরচা হয়ে গেল মনে হচ্ছে।"

-"ওসব ভাবিস না তো। মা-বাপি তোকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসে।"

-"আমি তো তোদের কেউ নই।"

-"সবসময় সব সম্পর্কের ব্যখ্যা হয় বল?"

-"কি জানি!.. তবে মা, দিদার পর শুধু তোদেরই দেখলাম, যারা আমার কত এত ভাবিস।"

-"সামনে ভাবার জন্য বউ এসে যাবে।"

-"ওই না! বেশি বুঝিস.. কত বার বলি কথাটা!"

-"ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ডিপার্টমেন্টে সুন্দরীর অভাব আছে নাকি?"

-"হয়তো আছে। তবে ভালোবাসাটা কি সৌন্দর্য্যে আসে?"

-"না আসলেও, হয়তো কাছে থাকাতে আসে।" বিদিশা দীর্ঘশ্বাস নিল.. রোহন বুঝল মেয়েটি একটু হলেও বিষাদে আছে। সেটাই স্বাভাবিক, কালই তো রোহন বাড়ি ফিরে যাবে, ফের একা হয়ে যাবো ও।

-"ভালোবাসাটা কিসে আসে, আমিও ঠিক জানি না এখনও। তবে জেনে ফেললে তোকেও জানাবো কেমন?"

বিদিশা চোখে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে রোহন। অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক ইচ্ছে সময়ের মত অদৃশ্য হয়ে দেখতে থাকে তাদের দুজনকে। শীত বাড়ে। বাতাস ঘন হয়ে আসে।

*॥৮॥*

১৫ই জানুয়ারী, ২০১৮,
বারাসাত,

-"কোই মা? দেবে না খেতে?"

-"এই হয়ে গেছে.. আসছি।"

বাড়িতে আজ পিঠে হয়েছে নানান রকম। সব রোহনের মা একাই করেছেন। একটু আগে বাবা ফোন করেছিলেন.. আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফিরছেন তিনি।

দুপুরেই রোহন বাড়ি ফিরে এসেছিল। মা অবশ্য ছেলের এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাতে অতটা অবাক হননি যতটা আজ তাকে একটিবারের জন্যেও ফোন না ধরতে দেখে হয়েছেন। রোহন বারান্দা দিয়ে পায়চারি করবার সময় মাঝে মধ্যেই রান্না ঘরে ঢুকছে, আর মা-ছেলের মধ্যে চলছে সাত রাজ্যের গল্প। রুনুদির বিয়ে, বল্টুর মাধ্যমিক পরীক্ষা, ভালো পিসিমণির অসুস্থতা... কথায় কথায় কোনো কিছুই বাদ থাকল না!

আজ মাকে অনেকটা সময় দিয়েছে সে। মায়ের মুখটা আজ বড়োই প্রাণবন্ত লাগছে। রোহনও আজ অনেকদিন বাদে খুশি অনুভব করল।

-"এই নে.. তোর ছাঁচপিঠে তৈরী।" মা হাতে একটি বাটি নিয়ে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন।

-"ঝাল দিয়েছো তো?"

-"দিয়েছি। আমি কি জানি না আমার ছেলে কি খেতে পছন্দ করে? তবে স্টোভে করা তো, উনুনে করলে আরো ভালো হত।"

-"আচ্ছা, দাও আগে। খেয়ে দেখি।"

-"দাঁড়া, ঠাণ্ডা হোক।"

বারান্দায় থাকা টেবিলের ওপর বাটিটা রেখে দিলেন তিনি। রোহন একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসে পড়ল। একদম গরম খাবার সে খেতে না পারলেও ঠাণ্ডা হওয়ার তর সইছিল না। তাই টুক করে একটা পিঠে তুলে দাঁত বসালো..

-"না মা.. ভালোই ঝাল দিয়েছো। পুরো চোখে নাকে জল.."

-"আগে খেয়ে নে। তারপর কথা বলিস।"

-"মা, জল দাও.."

-"বিষম খেয়েছিস? দাঁড়া।" মা কাছে থাকা একটা বোতল দ্রুত এগিয়ে দিলেন। রোহনও ঢক ঢক করে গলা ভিজিয়ে নিল। খেতে খেতে কথা বলতে অনেক বারই বারণ করেছে মা। তবে বাঙালির ছেলে কি সেসব কথার ধার ধারে?

-"ভেবেছিলাম, এবছর আর ঝাল পিঠে খাওয়া হবে না। কিন্তু তুমি করলে শেষমেশ।"

রোহনের মা এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত রাখল। তিনি খানিকখন নীরব হয়ে থাকলেন। অন্যদিন তার নীরব চোখের নীচে জলের ফোঁটা জমে.. ঠাণ্ডা পানীয়তে ভরা গ্লাসের মত। তবে আজ নয়। মাতৃত্বের স্বাদ আগেই তিনি আস্বাদন করেছেন.. কিন্তু মাতৃত্বের মূল্য হয়তো এখন।

-"আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, তোর কোনো আবদার অপূর্ণ থাকবে নারে।"

রোহন কিছু বলে না। আরেকটা পিঠে একটু একটু করে খেতে থাকে। এটা অনেকেই করে। যখন খিদে পায়, দাঁতগুলো খাবারের শেষপ্রান্তে পৌছনোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আবার পেটে ইঁদুর দৌড়নোর বদলে যদি মনে ভাবনারা দৌড়ায়, তখন মানুষ নিজেই ইঁদুরের মত ধীরে ধীরে খেতে থাকে।

-"তোমাকে আজ কত খাটালাম না? পিঠে করা তো চাট্টিখানি কাজ নয়।"

-"খাটুনি থাকলে মন ভালো থাকে। আর কিচ্ছুটি খাটাসও নিই তুই।"

রোহন মায়ের দিকে তাকালো, মৃদু হাসল।

-"তুমি আর দিদা আমার সমস্ত পছন্দ বোঝো। কত জ্বালিয়েছি, অমান্য করেছি তোমাদের। তবুও কত ভালোবাসো।"

-"এই ভালোবাসাটাই তো মুক্তিরে.."

রোহন চুপ হয়ে গেল। মা যে কথাটা বলল.. কোথায় যেন মনের ভেতর দাগ কাটল।

কাকে যেন একটা উত্তর দিতে হত। বা, নিরুত্তর থাকলে আর চলবে না।

-"মা, কিছু পিঠে একটু কেটলিতে করে দাও তো। সুশীলদের দিয়ে আসি। ও তো প্রতিবার পিঠেপুলিতে আমাদের বাড়ি আসত আগে।"

-"ওর জন্য কিছু রেখেছি। বলতামই যে দিয়ে আয়।"

-"আচ্ছা, আমি রেডি হচ্ছি তাহলে।"

-"এখুনি যাবি?"

-"হ্যাঁ। অনেক দিন দেখা হয়নি.."

*॥৯॥*

১৪ই জানুয়ারী, ২০০৬,
চাঁদপাড়া,

শীতের ভোর। চারিদিক একটু চুপচাপ। তবে গ্রাম তো, এখানে সবার ঘুম চারটে নাগাদই ভেঙে যায়। তাই পরিবেশটিকে নির্জন বলা যাবে না।

ছোট্ট রোহনের ঘুম ভাঙল যখন তখনও ঘুলঘুলি দিয়ে ঘরে আলো ঢোকেনি। তবে পেচ্ছাপ পেয়েছে খুব, শুয়ে থাকবো ভেবেও শুয়ে থাকা যায় না।

রোহন কম্বল সরিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। মা, বাবা এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ধীরপায়ে ঘরের বাইরে বেড়োলো। উঠোনের ওপাড়ে বাথরুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৃপ্তি লাভ করল সে।

ফেরার পথেই পড়ে উঠোনের লিচু গাছটি। যার পাশেই দিদিমায়েদের রান্নাঘর। আগুনে শুকনো পাতা পোড়ার শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই দিদিমা সকাল সকাল রাঁধতে বসে গেছে।

কৌতুহলী হয়ে রোহন এগিয়ে গেল সেখানে। গায়ে শালমুড়ি দিয়ে দিদিমা উনুনের সামনে বসে।

-"উমম... পিঠে করছ!" রোহন পিছন থেকে শব্দ করল।

-"করছি তো। ছাঁচ.. পুলি... সবই।"

-"ঝাল করবে তো?"

-"করব। তবে একটু বাদে। আগে তোমার বাপির জন্য করেনি? বাপি তো আবার ঝাল পছন্দ করে না।"

-"আচ্ছা।"

বলে রোহন দিদিমার পাশে বসে পড়ল। রোহনকে বসতে দেখে তিনি তার গায়ে শালটা দিয়ে দিলেন।

-"দিদা, বাপি বলল, নাকি বারাসাতে নিয়ে যাবে। এখানে আর থাকব না আমি।"

-"হ্যাঁ, ওখানে জমি কিনেছে একটা। সেখানে একটা সুন্দর বাড়ি আছে.."

-"কতবার বলবে এককথা? আমি বলছি তো যাবো না।"

-"যেতে যে হবেই বাবুসোনা। ওখানে ভালো ভালো স্কুল আছে। পড়তে হবে সেখানে। মানুষের মত মানুষ হতে হবে।"

-"আমি মানুষ হব না।"

-"কি হবে তাহলে?"

-"ওই হুলো বিল্লীর মত হবো। যখন তুমি রান্না করো, এখানে চলে আসে। আমিও ওর মত সবসময় তোমার সঙ্গে থাকব।"

-"ওরে, ও কি আর সবসময় বসে থাকে? মাঝে মাঝেই পঞ্চাদের বাড়ি যায়, টুনীদিদিদের বাড়ি যায়। তারপর আবার ফিরে ফিরে আসে। তুমিও আসবে এখানে, ঘুরে যাবে মাঝে মধ্যে।"

-"দিদা.. তুমি কষ্ট পাবে না?"

-"একদম না। জানবো আমার বাবুসোনা মন দিয়ে পড়াশুনা করছে। এবং দূর থেকে উনুনে পাতা ঢালার শব্দ কান পেতে শুনছে। এবং তারপর হঠাৎ করে পিঠে খেতে চলে এসেছে।"

-"আমি দূর থেকেও ওই শুকনো পাতা পোড়ার শব্দ শুনতে পাবো?"

-"অবশ্যই পাবে। আমার বুকের টুকরো তুমি, আমার বুকের ডাক পৃথিবীর যেকোনো জায়গা দিয়েই শুনতে পাবে।"

রোহন শালটা ভালো করে জড়িয়ে দিদিমার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমটা এখনও পুরো হয়নি.. চোখ বুজে এলো তার।

..........

সেদিনের পরও পুজোর সময় প্রতিবার রোহন দিদিমার কাছে পুজোর সময় আসত। যদিও শেষবার সে বন্ধুদের সাথে কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিল.. দিদিমায়েদের গ্রামে আসা হয়নি।

হ্যাঁ, সেবছরও ফিরেছিল সেখানে। তবে শুকনো পাতা নয়, শুকনো কাঠ পোড়ার শব্দে।

*॥১০॥*

১৬ই জানুয়ারী, ২০১৮,
ঝাড়গ্রামের অভিমুখে,

-"তারপর অনীতার সাথে যোগাযোগ করিসনি?"

-"কেনো? লেংগি দেবে, তারপর বিদিশার কাছে ফিরব?"

-"তাহলে সুখবর দিই। ভুলু বলল, ওকে নাকি অনীতা রেসপন্স দিচ্ছে.. এই আজ ওরা..."

-"থাক।"

রোহন ঠাণ্ডা গলায় বলল। চলন্ত ট্রেনে সে ও সুশীল, একে অপরের মুখোমুখি বসে আছে। ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষণ। আর একটু পরেই ওরা ঝাড়গ্রামে পৌছে যাবে।

জানালার বাইরে তখন সকালের সূর্য ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। ভোরের কুয়াশাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

বাইরে কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে রোহন পকেট থেকে গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেটটা বেড় করল।

-"নিবি একটা? খেয়ে দেখ।"

-"না, আমি খাই না। আর এটা ট্রেন, পাবলিক প্লেস। খাস না এখন।"

-"এটা প্লেস? ডিসপ্লেসমেন্ট হচ্ছে দ্রুতই।"

-"যাই হোক.. ওই.. পাবলিক প্রপার্টি... কিছুতো একটা হবে।"

-"তুই খুব সাধু পুরুষ না? কোনো নেশা করিস না?"

-"করে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে চাইনা। দাদু ফুঁকেই তো মরলেন। মরার আগে দু লাখ খরচাও করালেন।"

-"মাঝে মাঝে নেশারও দরকার আছে। ক্ষতি না হলে আমরা লাভের মূল্যটা ঠিক চিনতে পারি না।" বলে রোহন তার গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেটটি সুশীলের হাতে গুঁজে দিল।

সুশীল একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। বন্ধুদের হাবভাবের পরিবর্তন দেখা সেই মাধ্যমিকের সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। এসবে সুশীল অভ্যস্ত। কিন্তু বদলে যাওয়া মানুষের আগের মতন হয়ে যাওয়াটা তার কাছে খুব আশ্চর্যজনক ঠেকল।

কাল রাত তখন নটা বাজবে। এই ঠাণ্ডার মধ্যে রোহন ওর সাথে দেখা করতে মেসে আসবে.. এটা ওর কাছে স্বপ্নের মত হলেও, অস্বাভাবিক নয়। তবে হাতে করে খাবারের কেটলি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বুঝেছিল, আজ হাওয়াবদল ঘটেছেই।

-"তোর মায়ের রান্নার হাত দারুণরে। স্টোভে রান্না করেও অপূর্ব ছাঁচপিঠে করেছে। ঠিক দিদার মতনই।"

-"দিদা রান্নাটা করত মাটির উনুনে। ওর স্বাদ টোটালি আলাদা হয় ভাই।"

-"যা হোক, এবছর ওরকম তো আর.."

-"না না, এবছরও তোকে ওরকম খাওয়াবো।"

-"কীভাবে!?"

-"বিদিশাদের বাড়ি চ।"

-"বিদিশা যেন তোর জন্য রেঁধে বসে আছে? কাল তোর ফোন কল তো ধরলই না। আমি ফোন করলে বলল নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"

-"হলে হবে। থোড়াই ওর বিয়ে ভাঙতে যাবো?"

রোহন একগাল হেসে নিল। সুশীল একটু হলেও আনন্দিত তার বন্ধুর মুখের হাসি দেখে। আর যাই হোক, নির্ভেজাল এই হাসিটি। ফোনের স্মাইল ডিটেক্টর তার মূল্য ধরতে পারবে না।

ট্রেনের গতি কমেছে। বাইরেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ওরা স্টেশনে ঢুকতে চলেছে। দুই বন্ধু মিলে ওপরের তাক থেকে নিজেদের ব্যাগ নামিয়ে নিল। সামান্য ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল দরজায়।

ট্রেন থামতেই দুজনে নেমে পড়ল। বাইরে বেশ ভালো রোদ্দুর খেলেছে। স্টেশনে একটা খোলা হাওয়া আসছে.. অল্প ঠাণ্ডা। দীর্ঘক্ষণের ট্রেন জার্নির ক্লান্তি দূর করতে সুশীল নিজের হাত দুটো দুপাশে টানটান করল।

-"ওই যে.. দেখ বিদিশা এসেছে.."

-"কোনটা"

-"ওই যে.. হলুদ চুড়িদার.." রোহন আঙুল দিয়ে একটি মেয়েকে দেখালো। ওই তো, হাত কুড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। গায়ে হলুদ চুড়িদার, সাথে গোলাপি ওড়না। শ্যামলা দেখতে। ছিপছিপে। কাকে যেন খুঁজে চলেছে।

আর দশটা মেয়ের মধ্যে থাকলে হয়তো নজরে পড়ত না। তবে সুশীল বোঝে, রোহনের মনে ওর ছবি গেঁথে আছে।

-"যা ভাই। আমি বরং মালপত্র নিয়ে অন্য কোনো গাড়িতে করে পৌছবো। ঠিকানা তো বলেই দিয়েছিস।" বলেই রোহনের পিঠ চাপড়ে তাকে এগিয়ে দিল সে।

রোহন ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। বিদিশার কাছাকাছি আসতেই সেও তার দিকে তাকালো। চেহারাটি নিরুত্তাপ, সেই দু বছর আগে প্রথম সাক্ষাতেরই মতন।

-"এসেছিস কেনো? বললাম না বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।" বিদিশাই শীতলতা ভাঙল।

-"সরিয়ে দিচ্ছিস আমাকে, তাই তো?"

-"সরানোর কি আছে। নিজে থেকেই তো সরে গেছিস।"

-"ছোটোবেলায় যখন দিদার বাড়ি ছেড়ে চলে আসছিলাম, বলেছিল যে আমি কাছে না থাকলেও কোনো কষ্ট পাবে না। অনেকটা তোর মতনই।"

-"মানে? বললাম তো আমার সাথে অন্য কারোর জীবন বেঁধে গেছে। চলে যা।"

বিদিশা উল্টোদিকে পা বাড়ালো। যদিও রোহন তার আগেই তার হাত ধরে বসেছে।

-"হাতটা ছাড়.." রোহনকে তার হাত ছাড়তেই হল।

-"অভিমান ও অভিনয়.. দুটোই সত্যি ঢাকতে আসে, কি বলিস?"

-"বুঝেছিস যখন এবার আসলেই হয়। আমার জীবনে যাই হোক না কেনো, তোর তাতে কি? যে মেয়েটার সাথে সংসার বেঁধেছিস, যা না তার কাছে!"

-"যদি বলি দূরে চলে গেছিলাম বলেই তোর আকর্ষণটা বুঝেছি?"

-"অন্য জন ঠেলে দিয়েছে?"

-"না।"

-"সন্তুষ্ট করতে পারেনি তোকে?"

-"না।"

-"ভুল বুঝতে পেরেছিস.. এই বলবি তো?"

-"না.. তাও নয়।"

-"তো?"

-"জাস্ট ভালোবাসি। তাই কোনো অজুহাত নয়।"

বিদিশা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। সামান্য মাথাটা ঝুকিয়ে নিল তারপর.. ওর চোখ থেকে হাল্কা জল পড়ছে... নরম গালের ওপর ঈষদুষ্ণ কয়েটি ফোঁটা...

-"চল, বাড়ি যাবি। তোর পছন্দের ঝাল ছাঁচপিঠে করেছি।"

-"কান্নাটা থামা আগে।"

-"কোই.. কাঁদছি না তো..."

ওড়না দিয়ে নিজের চোখদুটি মুছে নিল সে। যেন বৃষ্টির পর কোনো ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ভেজা পাতাকে মুছে দিল। রোহন এখন তার কাছে কেবল রোহন নেই, যেন দীর্ঘ শ্রাবণের পর উঠোনে ধরা দেওয়া রোদ্দুর।

-"জামাকাপড় কিছু আনিসনি? কয়দিন থেকে যেতে পারিস তো নাকি?"

-"এনেছি তো। সুশীলকে বলা আছে। ও তোদের বাড়িতে পৌছে যাবে সব নিয়ে।"

-"তো চল এবার, একটা ট্যাক্সি ডাকি।"

-"উঁহু.. রিক্সায় যাবো।"

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল বিদিশা। এই হাসিটিই কতই না তাড়িয়ে বেড়িয়েছে রোহনকে।

জীবনে আর একটি নারীর উপস্থিতি সে পেয়েছে.. যার কাছে নিজেকে বড়োই মুক্ত বলে মনে হয়।

স্টেশনে পরবর্তী ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হল। রোহন আর বিদিশা ক্রমশঃ টিকিট কাউন্টারের দিকে হেঁটে এগিয়ে গেল।

দূর থেকে সবটাই দেখছিল সুশীল। আজ কাঁধে দুটো ব্যাগ, তবে ভারী মনে হচ্ছে না। বন্ধুকে দেখে সে নিজেও হাল্কা। প্ল্যাটফর্মের অন্যদিক দিয়ে ধীর পায়ে বেড়িয়ে এলো সে।

ভিড় ও গাড়ি সামলে রাস্তার একপাশে এক ফাঁকা জায়গায় পৌছল সে। মাথার ওপর একটি পলাশ গাছ। সবে মাত্র তাতে কুঁড়ি ধরেছে। এখানকার আকাশে রক্তিমতা ছড়িয়ে পড়তে দেরী নেই।

পকেট থেকে বেড় করল গোল্ড ফ্লেকের খাপটি। রোহনের ব্যাগের উপরের জিপটা খুলেই লাইটারও পেয়ে গেল।

একটা সিগারেট বেড় করে তাতে আগুন ধরালো। আগে কখনও খায়নি, তবে আজ এই অবসরে একটু টেনে নিলে ক্ষতি কি?

মাঝে মাঝে স্বাদ বদলেরও প্রয়োজন আছে।

*॥॥॥॥॥॥ সমাপ্ত ॥॥॥॥॥॥*

দেখতে দেখতে মকরক্রান্তি হয়ে গেল, শীতও শেষ। সকলের জীবনে বসন্ত আসুক.. চিরনতুন সুবাসে।

গল্পটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতেই পারেন। বন্ধুবান্ধবদের *Forward* করতে চাইলেও অমত প্রকাশ করব না.. ����

                    ~ *স্বপ্নময়* ��

লেখকের FB Link : fb.com/swapnomoy.sarkar.2
লেখকের WhatsApp No. 9163636879
প্রতিলিপি App : bit.ly/2rWfOLp

No comments:

Powered by Blogger.